‘ফোন পেয়েছেন নাজমুল হাসান’ – এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে বেশ তোলপাড় পড়ে যায়। এমনিতে মন্ত্রিসভায় কারা থাকছেন, এই কৌতূহল তো দেশজুড়েই থাকে। সেখানে বিসিবি সভাপতিকে যখন মন্ত্রীত্ব দেওয়া হয়, আগ্রহটাও তখন ভিন্ন মাত্রা পায়। নতুন মন্ত্রিসভায় নাজমুল হাসানের জায়গা পাওয়ার কথা জেনে প্রায় সবারই তাৎক্ষণিক ভাবনা কিংবা প্রশ্ন, তাহলে বিসিবি সভাপতি কে হচ্ছেন?
সামাজিক মাধ্যমে এটা নিয়ে আলোচনার ঝড় চলছে বুধবার সন্ধ্যা থেকেই। ক্রীড়াঙ্গনের নানা প্রান্তেও কম-বেশি কথা চলছে। তবে সেই আলোচনার ঢেউ বিসিবিতে খুব একটা স্পর্শ করেনি। মূল কারণ, সরকারের মন্ত্রী ও বিসিবি সভাপতি, এই দ্বৈত দায়িত্ব চালিয়ে যেতে আইনগত, সাংবিধানিক কিংবা গঠনতন্ত্রের কোনো বাধা নেই। একসময় বরং মন্ত্রীদের মধ্যে থেকেই বিভিন্ন ফেডারেশনের প্রধানের দায়িত্ব বেশি দেওয়া হতো। ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচনে জয়ী হওয়া কারও ক্ষেত্রে সরকারি দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা আইসিসির আইনেও নেই।
অভিজ্ঞ ক্রিকেট সংগঠক ও বিসিবি পরিচালক জালাল ইউনুস, বিসিবির আরেক প্রভাবশালী পরিচালক ইসমাইল হায়দার মল্লিক, বিসিবি পরিচালক ও সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানসহ বেশ কজন পরিচালকের বিশ্বাস, নাজমুল হাসানই বিসিবি সভাপতির দায়িত্বে থেকে যাবেন এবং দুটি দায়িত্বই তিনি ভালোভাবে সামলে নেবেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস বললেন, বোর্ড প্রধানের পদে কোনো পরিবর্তন আসবে না বলেই তিনি মনে করেন।
“মন্ত্রীত্ব তার তো প্রাপ্য। সেই দক্ষতা ও সামর্থ্য তার আছে। সে যেখানে কাজ করেছে, সেখানেই সফল হয়েছে। তাছাড়া সে রাজনৈতিক পরিবারে বড় হয়েছে, নিজেও দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছে। মন্ত্রী হিসেবেও অবশ্যই সফল হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই বুঝেশুনেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”
“মন্ত্রীর দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে, এটা জানার পর থেকে তার সঙ্গে আমার কথা হয়নি। অনেক ব্যস্ত আছে, ফ্রি হলে নিশ্চয়ই কথা হবে। (বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব নিয়ে) তার ভাবনা তাই বলতে পারছি না। তবে মন্ত্রির দায়িত্বের পাশাপাশি বিসিবি সভাপতি হিসেবেও তার চালিয়ে না যাওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। আইনগত কোনো বাধা নেই। আগেও তো কতজন একসঙ্গে এই দুটো দায়িত্ব চালিয়ে গেছেন। সেও খুব ভালোভাবেই পারবে।”
মন্ত্রিসভায় থেকে বিসিবি সভাপতির ভার সামলানোর নজির খুব বিরল নয়। হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের সরকারে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানোর পাশাপাশি বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। পরে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী বিএনপি সরকারেও পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমানকে বিসিবির প্রধান করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লিগ সরকার গঠন করার পর বোর্ড প্রধানের দায়িত্বে আসেন সাবের হোসেন চৌধুরি, যিনি সেসময় সরকারের নৌ-পরিবহন উপমন্ত্রীও ছিলেন।
বিসিবির ফিন্যান্স কমিটির প্রধান ও বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক তো কোনো সম্ভাবনাই দেখছেন না বিসিবি প্রধানের দায়িত্বে পরিবর্তনের। বরং বদলানোর ক্ষেত্রেই জটিলতার কথা বললেন এই বোর্ড পরিচালক।
“এই প্রশ্ন কালকে থেকে অনেকেই করছেন। কিন্তু আইনে বা গঠনতন্ত্রে যেহেতু কোনো বাধা নেই, এটা নিয়ে তাই প্রশ্ন ওঠারই কিছু নেই। উল্টো পাপন ভাই (নাজমুল হাসান) দায়িত্ব ছাড়তে চাইলেই কিছু ঝামেলা হতে পারে। তিনি যদি বোর্ড সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন, তখন বোর্ড তো আর ভেঙে যাচ্ছে না। বোর্ড পরিচালকদের নির্বাচন তো হয়েই গেছে। পাপন ভাই পদত্যাগ করলে তাই অন্য যে বোর্ড পরিচালকরা আছেন, তাদের মধ্যে থেকে কাউকে আবার সভাপতি নির্বাচন করতে হবে।”
“পুরো ব্যাপারটা তাই খুব জটিল হয়ে যাবে। পাপন ভাইয়ের সঙ্গে এটা নিয়ে আমার যদিও কথা হয়নি। তবে আপাতত এখানে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আমি অন্তত দেখি না। পরবর্তী বিসিবি নির্বাচনে যদি বদল আসে, তখন তো আসতেই পারে। সেটা সময়ই বলবে।”
বিসিবির সবশেষ নির্বাচন হয়েছে ২০২১ সালের অক্টোবরে। পরের নির্বাচন হওয়ার কথা তাই ২০২৫ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে। বিসিবি নির্বাচনে কাউন্সিলদের ভোটে শুরুতে বোর্ড পরিচালকরা নির্বাচিত হন। এরপর পরিচালকদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
নাজমুল হাসানই বিসিবির প্রথম নির্বাচিত সভাপতি। এর আগে সরকারের মনোনয়নেই সবাই দায়িত্ব পালন করতেন। নাজমুল হাসানের এখন টানা তৃতীয় মেয়াদ চলছে। তবে প্রতিবারই সভাপতি নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন তিনি। তার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী কোনোবারই ছিল না।
মন্ত্রী ও বিসিবি সভাপতির দ্বৈত দায়িত্ব নিয়ে আইনগত বাধা না থাকলেও নানা চ্যালেঞ্জ আছে। আগে যারা মন্ত্রী হয়ে এই দায়িত্বে ছিলেন, সেই সময়টায় বিসিবিতে পেশাদারিত্ব এখনকার মতো ছিল না। এত ব্যস্ততা, কাজের এতটা পরিধি ছিল না। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বাস্তবতা তখন ভিন্ন ছিল। কিন্তু এই সময়ে বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব পুরোপুরি সামলানোর পাশাপাশি মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসেবে শতভাগ দায়িত্ব পালন করা কঠিনই হওয়ার কথা।
“পাপন ভাই কিন্তু কর্পোরেট জগতেও খুবই সফল। বেক্মিমকো ফার্মা খুব ভালোভাবে সামলাচ্ছেন দীর্ঘদিন ধরে, ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি হিসেবে সফল। ক্রিকেট বোর্ডেও আমি মনে করি, খুব ভালোভাবে দায়িত্ব পালন করছেন গত ১১-১২ বছর ধরে। রাজনীতিতে জনপ্রিয়তা আছে তার, বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এখানেও তিনি সফল।”
“আমি কাছ থেকে যেটা দেখেছি, তিনি যে কাজটাই করেন বা যে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, সেটাতে খুব সিরিয়াস থাকেন। মন্ত্রীর দায়িত্ব নিশ্চয়ই ভেবেচিন্তেই নিচ্ছেন। আমার মনে হয়, তিনি দায়িত্ব ছাড়বেন না (বিসিবি সভাপতির)। এই সবকিছুই তিনি একসঙ্গে চালিয়ে যাবেন এবং সব দায়িত্বই সমানভাবে পালন করার সামর্থ্য তার আছে। তাকে সহায়তা করার জন্য আমরা তো আছিই। বোর্ডে তিনি সবকিছুই সুন্দরভাবে সাজিয়ে রেখেছেন। কোনো সমস্যাই তার হবে না।”
আকরাম খানের এই কথার প্রতিধ্বনিই শোনা গেল যেন জালাল ইউনুসের কণ্ঠে।
“আমি যতদূর জনি, আগের জাতীয় নির্বাচনের পরও তাকে (নাজমুল হাসান) মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে অনেক কথা হয়েছিল। কিন্তু সে খুব একটা আগ্রহী হয়নি। তার ভালোবাসার জায়গা ক্রিকেট, এখানেই থাকতে চেয়েছে। এবার যখন মন্ত্রী হচ্ছে, নিশ্চয়ই চিন্তাভাবনা করেই দায়িত্ব নিচ্ছে। ক্রিকেটও ছেড়ে যাবে না বলেই মনে করি। সবকিছুই দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে পারবে।”
“আর সত্যি বলতে, ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি হিসেবে তো প্রতিদিনই তাকে কাজ করতে হবে বা ব্যস্ত থাকতে হবে, এমন নয়। এটা পেশাদার অন্য সব প্রতিষ্ঠানের মতোই। সবাই যার যার কাজ করে যাবে। তার পর আমরা বোর্ড পরিচালকরা তো আছিই। প্রয়োজনের সময় বোর্ড সভাপতিকে পাওয়া যাবে। আমরা সবাই তাকে সবদিক থেকে সহায়তা করব। তার না পারার কারণ নেই।”
বিসিবির সব পরিচালকই অবশ্য এটা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে চান না। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরও দুজন পরিচালকও বলছেন, দুটি দায়িত্বই নাজমুল হাসান একসঙ্গে চালিয়ে যাবেন বলে বিশ্বাস তাদের।
0 Comments